- 10 November, 2024
- 0 Comment(s)
- 228 view(s)
- লিখেছেন : তামান্না
কেবল তোমরা, হে ইরানের নারীরা , রয়ে গেছো
হীনাবস্থা, দুর্ভাগ্য আর নিষ্ঠুরতার বাঁধনে ;
তোমরা যদি এই বন্ধনগুলো ভাঙতে চাও,
একগুঁয়েমির পোশাককে আঁকড়ে ধরো (হাতে অস্ত্র তুলে নাও, ফরোগ ফারোকজাদ)
ইরানের মাহসা আমিনির কথা মনে আছে?
বছর দুয়েক আগে ঠিক ভাবে হিজাব পরেননি বলে ইরানের নীতি পুলিশেরা তাঁকে হত্যা করেছিল। সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখা দিয়েছে, এবার নীতি পুলিশেরা ইরানের ইসলামিক আজাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী আহু দারিয়াইয়ের উপর চড়াও হয়েছিলেন। তিনিও নাকি হিজাব পরতে গাফিলতি করে ফেলেছিলেন। চুল দেখা যাচ্ছিল। "আয়াতুল্লাহ খোমেনির আপন দেশে,
আইন কানুন সর্বনেশে!" সর্বনেশে কাজ করার জন্যে ইরানের নারীদের কী যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়, তাহা তো আমরা জানিয়া গেছি।
১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লব ঘটে, এই বিপ্লব ইরানের আধুনিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। শাহ মোহাম্মদ রেজা পহলভির সরকারের বিরুদ্ধে জনরোষ বৃদ্ধি পেতে থাকে, কারণ তাঁর শাসনকে অনেকেই পশ্চিমা প্রভাব এবং স্বৈরাচারী বলে মনে করত। আয়াতোল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেইনির নেতৃত্বে এই বিপ্লব সংঘটিত হয় এবং ইরান একটি ইসলামিক প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়। নতুন সরকার ইসলামি শরিয়াহ আইনকে রাষ্ট্রীয় আইনে রূপান্তরিত করে এবং ধর্মীয় নিয়ম-কানুন কঠোরভাবে আরোপ করা হয়। এই বিপ্লবের নেতা, আয়াতোল্লাহ রুহুল্লা খোমেইনি ১৯৭৯ সালের ৭ মার্চ ডিক্রি বা নির্দেশনামা জারি করেন। তিনি ইসলামি বিপ্লবের পরে, বক্তৃতায় বলেন-"সব নারীকে তাদের কর্মক্ষেত্রে বাধ্যতামূলকভাবে হিজাব পরতে হবে এবং নারীরা মাথা না ঢাকলে সেইসব নারী কে 'নগ্ন' হিসাবে গণ্য করা হবে!"
তাঁর সেই বক্তৃতাকে বহু বিপ্লবী, নারীদের হিজাব পরতে বাধ্য করার নির্দেশ হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন, অনেকেই মনে করেছিলেন এই নির্দেশ রাতারাতি কার্যকর করা হচ্ছে। ইরানের নারীরা এর বিরোধিতা শুরু করেছিলেন।
আয়াতোল্লাহ খোমেইনির বক্তৃতার পরদিনই বিক্ষোভ জানাতে তেহরানের রাস্তায় একত্রিত হন এক লাখের ওপর মানুষ, যাদের বেশিরভাগই ছিল নারী। সেদিন ছিল আন্তর্জাতিক নারী দিবস।
এরপর, ১৯৮১ সালে নারী ও কিশোরীদের ইসলামি রীতি অনুযায়ী আব্রু রক্ষা করার উপযোগী পোশাক পরা আইনত বাধ্যতামূলক করা হয়। এর অর্থ হল নারীদের চাদর পরতে হবে অর্থাৎ তাদের পা অবধি পুরো শরীর ঢাকা ঢিলেঢালা পোশাক পরতে হবে এবং তার সঙ্গে নিচে ছোট একটা স্কার্ফ পরতে হবে। অথবা পুরোদস্তুর হিজাব এবং তার সঙ্গে লম্বা হাতা ওভারকোট দিয়ে শরীর ঢাকতে হবে।
পার্লামেন্ট ১৯৮৩ সালে সিদ্ধান্ত নিল যেসব নারী প্রকাশ্যে মাথা ঢাকবেন না, তাদের শাস্তি হিসাবে ৭৪ বার বেত্রাঘাত করা হবে। সম্প্রতি এই সাজার সঙ্গে আরও যোগ হয়েছে ৬০ দিন পর্যন্ত কারাবাস।
প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত কট্টরপন্থী ধর্মীয় নেতা ইব্রাহিম রাইসি ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট একটি নির্দেশে স্বাক্ষর করেন, যেখানে নতুন তালিকাভুক্ত বিধিনিষেধ ঘোষণা করেন। এতে বলা হয় নারীরা কী ধরনের পোশাক পরে প্রকাশ্যে আসছে, তা পর্যবেক্ষণের জন্য ক্যামেরা বসানো হবে। আইন লংঘনকারী নারীদের হয় জরিমানা দিতে হবে, নতুবা তাদের ‘কাউন্সেলিং’ এর জন্য পরামর্শ দেয়া হবে। (তথ্যসূত্র - বিবিসি নিউজ বাংলা, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২)
২ নভেম্বর আহু দারিয়াইয়ের একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে, ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে, অন্তর্বাস পরে একজন নারী ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কখনও স্থির হয়ে বসে আছেন। তাঁর পাশ দিয়ে অসংখ্য হিজাব পরা কৌতূহলী মুখ পেরিয়ে যাচ্ছে। ২ নভেম্বর, ক্লাস থেকে তাকে নীতি পুলিশেরা সিকিউরিটি অফিসে নিয়ে যায়। হিজাব ঠিকভাবে না পরার কারণে তাঁকে নানান ভাবে হেনস্থা করা হয়। কঠোর শাস্তি হিসাবে তার উর্ধাঙ্গের কাপড় খুলে ক্যাম্পাসে বের করে দেওয়া হয়। আহু প্রতিবাদী হয়ে, সমস্ত জামাকাপড় খুলে ফেলেন। শরিয়াহ আইনকে তোয়াক্কা না করে, সে অন্তর্বাস পরে ইরানের ধর্মগুরুদের মুখে ঝামা ঘষে দিয়ে, উইম্যান লাইফ ফ্রিডম খুঁজে নেবার চেষ্টা করেন! এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা কর্মীরা আহুকে আটক করেন। ইদানিং ইরানে নতুন এক শাস্তির ব্যাবস্থা করা হয়েছে। হিজাব সংক্রান্ত কোন সমস্যা হলে, নারীদের মানসিক ভারসাম্যহীন বলে দাগিয়ে দিয়ে, সটান মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে। আহুর ক্ষেত্রেও একই পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে। তাঁকেও মানসিক ভারসাম্যহীন বলা হচ্ছে। দারিয়াই বর্তমানে কোথায় আছেন সে সম্পর্কে কোন আপডেট পাওয়া যায়নি। তবে স্থানীয় একটি সংবাদপত্র ফারজিকতেগান থেকে জানা যাচ্ছে তাঁকে একটি মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল দারিয়াইকে অবিলম্বে মুক্তি দিতে ইরানি কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। ইরানের মানবাধিকার কমিশনের জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদক মায়ো সাতো বলেছেন- ‘আমি এই পরিস্থিতির নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করবো।’
ভারতে গুটিকয়েক সংবাদ চ্যানেল এই খবরটি প্রকাশ করেছে। ইউটিউব ভিডিওর কমেন্ট বক্স দেখে ভিরমি খেতে হচ্ছে, যাহা ইরান তাহাই ভারত মনে হচ্ছে। চাচারা নেগেটিভ কমেন্টে ভরিয়ে দিয়েছেন, জাত গেলো জাত গেলো বলে চিল্লাচ্ছেন। তাহারা কমেন্টে বলছেন- ‘নগ্ন হয়ে ঘোরা, কখনো স্বাধীনতা হতে পারে না’, ‘হিজাব পরতেই হবে’, ‘ইরান সরকারকে আমরা সমর্থন করি’, ‘এই মহিলাদের খুন করা উচিত’ ইত্যাদি । কী সুন্দর চৌকস চাল চেলে, পিতারা আমাদের মাথায় ধর্মীয় ঘোল ঢেলে, জুজু দেখিয়ে, না তোমার জানু, বুক, খাঁজ, ভাজ, চুল, রেখা, ব্রায়ের স্ট্র্যাপ, স্যানিটারি ন্যাপকিন প্যাকেট সব কিছু নিয়ে ফিসফাস, চুপচাপ, রাখ ঢাক; ঐসব প্রসঙ্গ দূরে থাক! কিন্তু আপনারা যখন গামছা পরে, পশ্চাতদেশ চুলকাতে চুলকাতে বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়ান, খোলা রাস্তায় দাঁড়িয়ে মূত্র বিসর্জন করেন তখন এই রাখ ঢাক কোথায় থাকে? মেয়েদের পোশাকে, মেয়েদের শরীরে পৃথিবীর সমস্ত সমস্যা কেন লুকিয়ে আছে? কতবার আপনি আপনার ভাই, চাচা, দাদার মুখে ,পুরুষদের চোখ নামিয়ে হাঁটার প্রসঙ্গে শুনেছেন? হম্বিতম্বি কেবলমাত্র নারীদের বেলায়? ধর্মীয় দালালেরা তাঁদের এই মাতব্বরি যতদিন চালাবেন, ঠিক ততদিন নারীরা তাঁদের প্রতিবাদ চালিয়ে যাবেন। রাক্ষসী, ডাইনি, বেশ্যা বিশেষত্বে বিশেষিত করে পুড়িয়ে, পিটিয়ে, চুবিয়ে, জেলে, পাগলা গারদে পাঠাবেন, তবুও এই সমাজের বিধাতাদের বিরুদ্ধে নারীরা গর্জে উঠবে।
আহু দারিয়াইয়ের সাহস দেখে, মুগ্ধ হয়ে, সামাজিক মাধ্যমে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছেন নেটিজেনেরা। মনে আছে, মাহসাকে খুন করার খবর প্রকাশ্যে আসতেই ইরান জুড়ে প্রতিবাদ হয়েছিল, হাজার হাজার নারীরা রাজধানী তেহরানের রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ শুরু করেছিলেন। তাঁরা নারী অধিকারের দাবি তোলেন। স্লোগান দেন, ‘অত্যাচারীর মৃত্যু হোক’,‘নারী, জীবন, স্বাধীনতা’। মাহসার মৃত্যুর প্রতিবাদে বহু নারী চুল কেটে, হিজাব পুড়িয়ে প্রতিবাদে শামিল হন। তাঁরা চুলকাটা ও হিজাব পোড়ানোর ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করেন। আহুর হেনস্থার প্রতিবাদে, নারীরা এবার যদি অন্তর্বাস পরে প্রতিবাদে নামেন, তাহলে তো! তা যাই হোক না কেন, তবে একথা স্বীকার করে নিতেই হবে, আহু দারিয়াইয়ের অন্তর্বাস বিপ্লব ইতিমধ্যেই ইরানি নারীদের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি নতুন প্রতীক হয়ে উঠেছে!
লেখক : প্রাবন্ধিক, সমাজকর্মী
ছবি : সৌজন্য ইন্টারনেট
0 Comments
Post Comment